সবার খাজার মা তিনি


সবার খাজার মা তিনি


আমার এক দাদি আছেন বয়স আনুমানিক ৮০ বছর বা তার বেশি হবে। দাদির আসল নাম কি তা আমি নিজেও জানি না। কিন্তু সবাই উনাকে খাজার মা বা খাজার মা দাদি বলে ডাকে।


এ তো গেলো সামনা-সামনি সম্বোধনের কথা। আবার যখন দাদির অনুপস্থিতিতে উনার সম্পর্কে কিছু বলে তখন ও একই ধরনের সম্বোধনা উনার ব্যাপারে উল্লেখ করে। এই যেমন- "খাজার মায়ের গাছ থেকে দুটো আম পেড়ে নিয়ে আসলাম" বা "খাজার মায়ের পুকুরে কাপড় কাঁচতে যাচ্ছি"।


এখানে উল্লেখ্য যে, দাদির এই সম্বোধন কেবলমাত্র  একটি নির্দিষ্ট বয়সের মানুষই ব্যবহার করছে না বরং ছোট-বড় সব বয়সের মানুষই সমানতালে বলছে। কিছু মানুষ হয়তে ভিন্নভাবে ডাকতে পারে কিন্তু সে সংখ্যা খুবই নগণ্য।


এই গল্প বলার কারণ কি?


এই প্রসঙ্গ উত্তাপনের মূল কারণ হলো বর্তমান সময়ের সাধারণ মানুষের মাঝে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধের, বয়সভিকি সম্মান ও সম্বোধনের এর গুরুত্বহীনতা এবং সমাজে নীরব নৈতিক অবক্ষয়ের একটি প্রেক্ষাপট এখানে তুলে ধরা। পাশাপাশি এখানে সমাজে অর্থ উপার্জনক্ষমতা বিহীন নারীদের প্রতি একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর সমাজের মানুষের উদাসীন ও গুরুত্ব হীন দৃষ্টিভঙ্গিকের প্রতিও আলোকপাত করা হয়েছে। একই সাথে এই গল্পে বড়দের থেকে যে কোন বিষয়ে ছোটদের অনুকরণ প্রিয়তা এবং সঠিক সময়ে সংশোধনের অভাবে সেটিই এক সময় স্বভাবে পরিণত হবার ব্যাপারেও  একটি প্রবণতা দেখা যায়।


এই "খাজা" আসলে কে?


আলোচ্য "খাজার মা" এর নামকরণের পেছনের মূল কারিগর হলো খাজা বা খাজা মিয়া যে কিনা দাদির একমাত্র ছেলে সন্তান । বর্তমানে খাজা মিয়ার বয়স আনুমানিক ৫০ এর কাছাকাছি।" একটা সময় হয়তো আমার এই দাদির ও একটা সুন্দর নাম ছিল যা হয়তো তার বাবা-মা খুব আদর করে রেখেছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় যখন তিনি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে পা রাখলেন তখন নিজের নামের পরিবর্তে  মানুষ তাকে বৌ/বৌমা/ভাবী/ অমুকের মা অমুকের বৌ ইত্যাদি নামে সম্বোধন করতে শুরু করলো আর এ সবের আড়ালে একসময় তার নিজের নামটাই ঢাকা পড়ে গেলো। নিজ নামের অস্তিত্ব তখন কেবলমান নিজ পরিবার, বান্ধবী ও  গ্রামবাসীর কাছে।


বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশিরভাগ বিবাহিত নারীরাই পরিচিতি পান স্বামীর নামে "অমুকের বৌ" হিসেবে। আর একসময় তার নিজ সন্তান (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছেলে) বড় হলে তখন সেই সন্তানের নাম অনুসারে "অনুকের মা" হিসেবে সম্বোধিত হন। একইভাবে আমার এই দাদিও কালের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন " খাজার মা"।


নিজ নাম ও বয়সভিত্তিক সম্মানের গুরুত্বঃ


এই পরিস্থিত মধ্য দিয়ে পার হতে হয় বাংলাদেশের বেশিভাগ নারীদের কিন্তু কাগজে-কলমে বা সম্বোধনে এই যে আমাদের সবার একটা করে নাম 


আছে সেটা, কেবই এফটি বিশেষ্য পদ নয় বরং আমাদের অস্তিত্ব বা সত্তার একটি অংশ। নিজের নাম হারিয়ে ফেলা  মানে কি নিজেকেই হারিয়ে ফেলা যা নিজের সাবেক বিসর্জন নিজ সত্তার আত্মহন নয় 


বলা বাহুল্য এই "মাজার মা" যদি আজকে কোন অভিজাত নারী হতেন, বা কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি হতেন, যদি কোন বড় চাকুরীজীবি যা ব্যবসায়ী হতেন অথবা কোন ডাকসাইটে নেত্রী হতেন তখন ঠিক সবাই উনাকে একই ভাবে খাসার মা" নামে ডাকত না।


আবার কোন ব্যক্তিকে তার বয়োজৈষ্ঠ্যরা যেভাবে সম্বোধন করবেন



তার সমবয়সী বা অনুজরা নিশ্চয়ই একইভাবে ডাকবে না। এটি কোনভাবেই আমাদের সামাজিক শিক্ষার অংশ নয় এবং কোন নৈতিআভাবেও শোভনীয়  নয়। কেননা জীবনের প্রতিটি ধাপে বরয় ভিত্তিক সম্বোধন ও সম্মান প্রতিটি মানুষেরই ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের অবস্থান নির্বিশেষে প্রাপ্য। 


আমাদের উপলব্ধি ও করণীয়ঃ


যে কোন সামজিক রীতিনীতি বা আচার যেমন একদিনে গড়ে ওঠে না তেমনি তা পরিবর্তন বা সংস্কার করার জন্যও  পর্যাপ্ত সময় ও সমাজের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয়। বয়স নির্বিশেষে আমাদের সকলেরই এই বয়সভিত্তিক সম্বোধন ও সম্মানবোধের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। কেননা কালের বিবর্তনে আমাদের সকলকেই হয়তো এই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পার হওয়া লাগতে পারে। এজন্য আমাদের অনুজদের ও আর বিশেষত শিশুদের সজাগ করতে হবে। কেননা শিশুরা অনুকরণপ্রিয় এবং এই স্বভাবের কারণে আমাদের করা অনেক ভুলই তাদেয় দৈনন্দিন আচরণের সাথে যুক্ত হয়।


 আর এক সময় যখন সেই আচরণ বদলে অভ্যাসে পরিণত হয় তখন তা বদলে ফেলা  দুষ্কর বা কোন কোন ক্ষেত্রে অসম্ভব হয়ে পরে। পরিশেষে বলতে চাই, বয়সভিত্তিক সঠিক সম্বোধন ও সম্মানবোধ যেমন সমাজে বয়োজৈষ্ঠ্যদের সঠিক মুল্যায়ন প্রতিস্ঠা করবে তেমনি তাদের প্রতি পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধক পরিবেশ তৈরি করবে। পাশাপাশি এই চর্চার মাধ্যমে অনুজদের নৈতিক মূল্যবোধের বিশাশ ঘটবে এবং মানবিক অবক্ষয় রোধ পাবে


কিন্তু বিষয়টি সার্বক্ষণিক তাদের  মনকষ্টের কারণ হলেও তেমন করে কেউ সচরাচর এর প্রতিবাদ করে উঠতে আছে না। কারণ কালের বিবর্তনে এটিই যেন স্বাভাবিক এবং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তারা 

নিজেরাও অতীত জীবনে এখন আচরণ করেছেন।



সর্বশেষ যেটা বলতে চাই দাদির একটা নিজেস্ব ব্যক্তিত্ব আছে এবং তার একটা পরিচয় আছে যার কাছে সে দাদি তিনি তাকে দাদিই বলবেন, যার সম্পর্কে তিনি চাচী তিনি তাকে চাচী বলবেন তার সমবয়সীরা তার সন্তান এর নাম ধরে তাকে ডাকতে পারেন বয়স ও সম্পর্কের উপর নির্ভর করবে তাকে আপনি কি নামে ডাকবেন । আশা করি আপনাদের বোঝাতে পেরেছি ।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url